ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

টেকনাফের মাথিন কূপ : ট্রাজেডীর উপাখ্যান

10521094_659099600852607_1676024027868759937_n-400x225 matinkup teknafচকরিয়া নিউজ ডেস্ক :::

টেকনাফ শহরের প্রাণকেন্দ্র নাফ নদীর পাশে টেকনাফ পুলিশ ফাঁড়ির চত্বরে এই মাথিনের কূপ। এই কূপের পেছনে রয়েছে এক বেদনাবিধুর প্রেম কাহিনী। রাখাইন জমিদারকন্যা মাথিন আর এক পুলিশ কর্মকর্তার প্রেম সময়কে জয় করে নিয়েছে প্রেমের বিরহ, অপেক্ষা আর প্রয়াণের কাব্যে। ঐতিহাসিক প্রেমের এই দুই নর-নারীর আখ্যান আজও মনে নাড়া দিয়ে যায়।টেকনাফ শহরের প্রাণকেন্দ্র নাফ নদীর পাশে টেকনাফ পুলিশ ফাঁড়ির চত্বরে এই মাথিনের কূপ। এই কূপের পেছনে রয়েছে এক বেদনাবিধুর প্রেম কাহিনী। রাখাইন জমিদারকন্যা মাথিন আর এক পুলিশ কর্মকর্তার প্রেম সময়কে জয় করে নিয়েছে প্রেমের বিরহ, অপেক্ষা আর প্রয়াণের কাব্যে। ঐতিহাসিক প্রেমের এই দুই নর-নারীর আখ্যান আজও মনে নাড়া দিয়ে যায়।

প্রেম কাহিনী :
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের ঘটনা। কলকাতার সুদর্শন পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচায্য অতি ভয়ংকর ও দূর্গম এলাকা টেকনাফ থানায় বদলি হয়ে আসেন। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা টেকনাফ থানা – অদূরে সমুদ্রের নীল জলরাশি।একাকী, নিভৃত্বে নিজের কাজ নিয়ে সময় কাটাতেন ধীরাজ। কাজের ফাঁকে অবসর পেলে চলে যেতেন প্রকৃতির সানি্নধ্যে। তখন টেকনাফে সুপেয় পানির খুব অভাব ছিল। সমগ্র টেকনাফের মধ্যে থানা কম্পাউন্ডে তখন একমাত্র বিশাল একটি পানির কূপ ছিল। এই কূপেই সুপেয় পানির জন্য রোজ ভিড় জমাত স্থানীয়রা। আশপাশের রাখাইন তরুণীরাই বেশি আসত পানির পাত্র হাতে কূপে ফেলত বালতি। এ ছাড়া থানা কম্পাউন্ডে কেউ কেউ থানার ছোট্ট বাগানের শিউলী ফুল তুলত। রাখাইনদের চিরাচরিত পোশাকেই দেখা যেত কূপের কাছে।

10521094_659099600852607_1676024027868759937_nথানায় তার তেমন কোন কাজ কর্ম ছিলোনা। অনেকটা এখানে সেখানে ঘুরে ফিরে সময় কাটাতেন। থাকতেন থানার আধাপাকা ঘরের একটি কক্ষে। একদিন ভোরে একাধিক নারী কন্ঠের অস্পষ্ট মৃদু গুঞ্জনে ধীরাজের ঘুম ভেঙ্গে যায়। থানার ছোট বারান্দায় এসে দেখলেন রঙ-বেরঙ্গের ফতুয়া (থামি- ব্লাউস) পরিহিতা ৫০/৬০ জন মগী রাখাইন তরুনী পাত কূয়ার চারদিকে জড়ো হয়ে হাসি গল্পে মশগুল। তাদের সুউচ্চ কলহাস্যে থানার প্রঙ্গণ মুখরিত। এটাই ছিলো সমগ্র টেকনাফে একটি মাত্র কূয়া। প্রতিদিন তরুনীরা পাত কূয়ায় জল নিতে আসতেন। আর ধীরাজ থানার বারান্দায় চেয়ারে বসে তরুনীদের জল তোলার দৃশ্য দেখতেন। একদিন ধিরাজের নজরে পড়ে সম্পূর্ণ নতুন সাজে সজ্জিত আরেক তরুনীকে, সুন্দরী এই তরুনীর নাক-চোখ, মুখ বাঙ্গালির মেয়েদের মত। নাম তার মাথিন। টেকনাফের জমিদার ওয়ান থিনের একমাত্র মেয়ে। প্রথম দর্শণেই মেয়েটিকে তার ভালো লেগে যায়। প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগেই ধীরাজ ভট্টাচায্য থানার বারান্দায় চেয়ারে গিয়ে বসতেন এবং মাথিনের আগমনের প্রতীক্ষা করতেন। মাথিন যখন কলসি কাঁখে তার সুউচ্চ গ্রীবা দুলিয়ে থানা প্রাঙ্গন দিয়ে হেঁটে আসতেন ধীরাজ তন্ময় হয়ে সে দৃশ্য উপভোগ করতেন। অন্যান্য তরুনীরা আসার আগেই মাথিন পাতকূয়ায় আসতেন এবং জল নিয়ে ফিরতেন। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশে তারা একে অপরের সাথে গভীর প্রেম ও মোহবেশে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন। পরস্পর পরস্পরের দিকে চেয়ে সম্ভব অসম্ভোব নানা কল্পনার রঙ্গিন জাল বুনতেন। দেখা-দেখি, হাসা-হাসি এভাবেই তাদের প্রেম ঘনীভূত হয়। দিন গড়াতে থাকে। একদিন দু’দিন এভাবে। ইতি মধ্যে দুজনের প্রেমের কথা সবাই জেনে যায়। নানা বাধা সত্ত্বেও দুজনের মধ্যে বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়। এরই মাঝে কলকাতা থেকে বাবার চিঠি আসে ধীরাজের কাছে। ধীরাজকে কলকাতা যেতে হবে এক মাসের ছুটি নিয়ে। ছুটি না মিললে চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে হলেও যেতে হবে। ধীরাজ সিদ্ধান্ত নেন কলকাতা যাবেন। সিদ্ধান্তের কথা মাথিনকে জানানো হলো। মাথিন রাজি হলেন না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে ধীরাজ এক সন্ধায় টেকনাফ ছাড়ে পালিয়ে গেলেন। ধীরাজের এভাবে চলে যাওয়াকে প্রেমিকা মাথিন সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেন নি। মাথিনের মনে হলো বাবার অসুখের কারণ দেখিয়ে ধীরাজ বরং বিয়ে করার ভয়েই পালিয়েছে।ধীরাজের এভাবে চলে যাওয়াকে প্রেমিকা মাথিন সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি।  প্রাণ পুরুষ ধীরাজকে হারিয়ে মাথিন অন্নজল ত্যাগ করে হন শয্যাশায়ী। জমিদার বাবা ওয়ান থিন সহ পরিবারের সদস্যরা শত চেষ্টা করেও মাথিনকে অন্নজল ছোঁয়াতে পারেন নি। তার এক কথা ধীরাজকে চাই। প্রেমের এই বিচ্ছেদ এবং অতি কষ্টে একদিন মাথিন মারা যান। এ কারনে প্রেমের সাক্ষী মাথিনের কূপ দেখে এখনো হাজারো প্রেমিক প্রেমিকা তাদের ঐতিহাসিক প্রেমের কথা স্মরণ করে আবেগ আপ্লুত হয়।

কিংবদন্তীর নায়ক ধীরাজ ভট্টাচার্য :
বাংলা চলচ্চিত্রের অজস্র অনুরাগীর অন্তর্লোকের যার ভাবমূর্তি চিরলাবণ্য ও  মহিমায় বিরাজমান তিনি হলেন ধীরাজ ভট্টাচার্য। তিনি নাটক, চলচ্চিত্র, পুলিশের চাকরি এবং সাহিত্যচর্চা এই চারটি ক্ষেত্রেই দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে তিনি তাঁর অসামান্য শৈল্পিক প্রতিভায় লক্ষ নরনারীর হৃদয়রাজ্যে হয়ে উঠেছিলেন এক রূপকথার খলনায়ক। ১৯৪৭-পূর্ব যুক্ত বাংলায় ধীরাজ ভট্টাচার্য নির্বাক পর্বে চলচ্চিত্রে বৃহততর পর্দায় ক্ষুদ্র ভূমিকা নিয়ে আবির্ভূত হলেও ক্রমে খ্যাতি পেয়েছিলেন রোমান্টিক নায়ক হিসেবে। পরে তিনি খলনায়ক এবং চরিত্রাভিনেতা হিসেবেও যথেষ্ট সমাদৃতহন। অভিনয় শিল্পের পাশাপাশি তাঁর দুটি উলে¬খযোগ্য গ্রন্থ ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ এবং ‘যখন নায়ক ছিলাম’ তাঁকে দিয়েছে ব্যতিক্রমী অসাধারণ লেখকের মর্যাদাও।

ধীরাজ ভট্টাচার্য ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন ১৯০৫ খ্রীস্টাব্দে যশোর জেলার কেশবপুর থানার পাঁজিয়া গ্রামে। পিতা ললিতমোহন ভট্টাচার্য ভবানীপুর মিত্র ইন্সটিটিউশনের শিক্ষক ছিলেন। নিজ গ্রামের পাঁজিয়া স্কুলে ধীরাজ ভট্টাচার্যের শিক্ষা জীবনের সূচনা হয়। পরে তিনি কলকাতা মিত্র ইন্সটিটিউশনে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। আশুতোষ কলেজে আই.এস.সি পড়াকালীন সময়ে সিনেমার প্রতি আকৃষ্ট হন। সুদর্শন চেহারা, ঘন কোঁকড়ানো চুল, ঈষৎ টেরা হলেও চোখের চাহনীতে মাদকতা। চিত্রপরিচালক জ্যোতিষ বন্দোপাধ্যায়ের পছন্দ হয়ে যায় তাঁকে। তাঁর সহায়তায় ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যাডান কোম্পানির নির্বাক ছবির ‘সতীলক্ষ্মী’তে প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পান। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ৭ নভেম্বর কলকাতার কর্ণওয়ালিস থিয়েটারে জ্যোতিষ বন্দোপাধ্যায় পরিচালিত নির্বাক ‘সতীলক্ষ্মী’ মুক্তি পায়। এ ছবির এক বখাটে যুবকের ভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে ধীরাজ ভট্টাচার্যের চিত্রজগতে প্রথম যাত্র শুরু। কিন্তু শুরুতেই যাত্রাভঙ্গ। আত্মীয়-স্বজনরা বলাবলি শুরু করলো ছেলেটা শেষ পর্যন্ত উৎসন্নে গেল সিনেমায় অভিনয় করে। পিতা-মাতার কাছে খবর গেল। তাঁদের ইচ্ছে ছিল আই.এস.সি পাসের পর ছেলে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। কিন্তু ধীরাজের রক্তে ছিল অভিনয়ের নেশা। তাই পরিবারের কাউকে না জানিয়ে হুট করে ঢুকে গেল সিনেমায়। সব শুনে তাঁর পিতা রেগে একেবারে আগুন। পিতা সামাজিক মর্যাদা রক্ষার জন্য পুত্র ধীরাজকে সিনেমা জগৎ থেকে সরিয়ে পুলিশের ইন্টেলিজেন্স ব্রান্সে (আই.বি) ভর্তি করে দেন। প্রথম পোস্টিং কলকাতায়।

কিন্তু যার রক্তে অভিনয়ের নেশা আর সিনেমার স্বাদ একবার যে পেয়েছে সে কি আর এই জগৎ ছেড়ে থাকতে পারে ! পুলিশের চাকরি ভালো লাগে না ধীরাজের। বদলি সূত্রে ধীরাজকে পাঠিয়ে দেয়া হলো চট্টগ্রামের টেকনাফে।

এদিকে ১৯৩০ সালে ধীরাজ ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত জীবনী নিয়ে লেখা “যখন পুলিশ ছিলাম” গ্রন্থে তারই ভালবাসার স্মৃতি আদরিনী মাথিনের কথাও লিখেছেন। লাহোরের ওবাইদুলাহ রোডের জিলানী ইউনিক প্রেস থেকে ১৯৩০ সালের ১ লা আষাড় বইটি প্রকাশিত হয়। ওই বইয়ের বিখ্যাত চরিত্রে মাথিনের কূপ সংশিষ্ট কাহিনীটি রচিত রয়েছে। তবে ভালবাসার জন্য রাখাইন জমিদার কন্যা মাথিনের এই জীবন বিসর্জন কাহিনী কোন ভাবেই মানতে রাজি নন টেকনাফের রাখাইনরা। তাদের দাবী, মাথিন কূপের এই প্রেম কাহিনী সাহিত্যিক পুলিশ অফিসার ধীরাজের লেখা উপন্যাসের কল্পিত চরিত্রের ইতিহাস মাত্র ।

পরের কথাঃ
কলকাতা যাবার পর ধীরাজ পুলিশের চাকুরী থেকে ইস্তফা দেন। নতুন পেশা হিসাবে তিনি ছবিতে অভিনয়কে বেছে নেন। তার অভিনিত ছবিগুলোর মধ্যে আরশা হিন্দু হোটেল, হানা বাড়ি এবং বিপ্লবী খুদিরাম অন্যতম। পরে তিনি নিজের জীবনি অবল্বনে দুইটি বই লিখেন যার একটির নাম “যখন পুলিশ ছিলাম” অন্যটি “যখন নায়ক ছিলাম”। এর পর ধীরাজ আর তার পরিবারের বিষয়ে খুব একটা জানা যায়নি।

পুলিশ প্রশাসন এই জায়গাটি সংরক্ষন করে এটিকে “মাথিনের কূপ” হিসেবে নাম করন করেন। ২০০৬ সালে ধীরাজ-মাথিনের ইতিহাসের প্রায় ৮০ বছর পর, টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জনাব খালেদ হোসেন, সাংবাদিক আব্দুল কুদ্দুস রানা কে সাথে নিয়ে এই কূপটির সংস্কার করেন এবং এটিকে একটি দর্শনীয় স্হান হিসেবে পরিচিতি দেন।

বর্তমান অবস্থা :
বর্তমানে প্রতি বছর দেশ-বিদেশের হাজার হাজার নারী-পুরুষ পর্যটক টেকনাফের ঐতিহাসিক মাথিনের কূপটি পরিদর্শনের জন্য ভিড় জমাতে দেখা যায়। যেখান থেকে এই সময়ের প্রেমিক প্রেমিকারা মাথিন ও ধীরাজের অমর প্রেম কাহিনী নিদর্শনের মধ্য দিয়ে তারা যে যার মত নিজেদের পবিত্র প্রেম-ভালবাসাকে মিলিয়ে নিচ্ছেন। এক তথ্যে জানা গেছে, ২০০৮ সালে প্রায় ২৫ লাখ টাকা ব্যায়ে মাথিনের কূপটি আধুনিকায়ন করা হয়েছে। টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ঐতিহাসিক মাথিনের কূপ পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজের অমর প্রেম কাহিনী ও তার স্মৃতি বিজড়িত। তাই থানা কম্পাউন্ডের ঐতিহাসিক এই কূপটির সৌন্দর্য্য রক্ষার্থে প্রশাসনিক ভাবে ব্যাপক নজরদারী রাখা হয়।

কীভাবে যাবেনঃ
টেকনাফ শহরের প্রান কেন্দ্রে নাফ নদীর পাশে টেকনাফ পুলিশ ফাঁড়ির চত্তরে এই মাথিনের কূপ। কক্সবাজার থেকে অনেক গুলো বাস সার্ভিস আছে, ভাড়ায় পাওয়া যাবে রেন্ট-এ-কার এর গাড়ি। ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট থেকে ২ ঘণ্টার ভিতরে আপনি চলে আসবেন সবুজ পাহাড়ে ঘেরা টেকনাফে।

 

পাঠকের মতামত: